ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি-ই শিবপুরাণ মতে মহাশিবরাত্রি। শিবকে বলা হয় আশুতোষ। অর্থাৎ আশু বা খুব তাড়াতাড়ি অল্পেই তুষ্ট হন যিনি! ফলে, তাঁকে তুষ্ট করার জন্য পঞ্চাক্ষর বীজমন্ত্র ”নমঃ শিবায়”-ই যথেষ্ট! নিষ্ঠা সহকারে, ভক্তি ভরে নমঃ শিবায়-এর উচ্চারণেই তাকে সন্তুষ্ট করা যায়।

ধ্যানমগ্ন শিবকে ”শিবলিঙ্গ” প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় , মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গে শিবের পূজা হয়। মহাশিবরাত্রির পূজা অন্য দিনের শিবপূজার চেয়ে একটা দিক থেকে আলাদা। এটি ব্রত অর্থাৎ, এটি বিশেষ পূজার দিন। যে কোনও ব্রত পালনের কিছু বিশেষ নিয়ম থাকেই। মহাশিবরাত্রিরও রয়েছে। যেহেতু সারা বছরব্যাপী শিবপূজার মধ্যে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ, তাই এই ব্রত পালন শুরু হয় মহাশিবরাত্রির আগের দিন থেকে। শেষ হয় পরের দিন। ত্রয়োদশী তিথি থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে এই বিশেষ পূজার জন্য। শিবপুরাণ মতে এবং মহাশিবরাত্রি ব্রতপালন বিধি অনুসারে ত্রয়োদশীতে এক বেলা নিরামিষ আহার খেয়ে থাকতে হয়। যাতে চতুর্দশীতে উদরে আহারের কণামাত্রও না থাকে!

মহাশিবরাত্রির দিন একেবারে সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়া নিয়ম। ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে নিতে হয়। মহা শিবরাত্রিতে একজন শিবভক্ত কালো তিলের সঙ্গে ফোটানো জলে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরিধান করবেন। শিবপুরাণ মতে, তাতে শরীর শুদ্ধ হবে। স্নান শেষ হয়ে গেলে সঙ্কল্পের পালা। কেন না, এই পূজা এবং ব্রত পালন করতে হয় নিজেকে সংযত রেখে। মনে মনে সঙ্কল্প করুন — চতুর্দশীর সারা দিন এবং রাত আপনি শুদ্ধ শরীরে এবং শুদ্ধ মনে উপবাস থাকবেন । সঙ্কল্প হয়ে গেলে “নমঃ শিবায়” বীজমন্ত্রে শিবকে প্রণাম জানান । তাঁর কাছে আশীর্বাদ কামনা করুন। যাতে আপনার সঙ্কল্প রক্ষা হয়। তারপর শিব মন্দিরে গিয়ে দুধ ও মধু দিয়ে শিবলিঙ্গকে ধৌত করবেন। তার সঙ্গে মনের সমস্ত পাপ ও অন্ধকার দূর করে আপনাকে জ্ঞানের স্রোতে স্নান করানোর আবেদন রাখবেন মহাদেবের কাছে।

অনেকে আজকাল দুপুরের মধ্যেই শিবপূজা সেরে নেন। কিন্তু যখন বলা হয়েছে মহাশিবরাত্রি, তখনই স্পষ্ট- এই পূজার আদর্শ সময় রাত। সারা রাত ধরে চলে মহাশিবরাত্রির ব্রত। তাই সন্ধেবেলাতেও একবার স্নান করে শুদ্ধ হয়ে পূজার জোগাড় করুন। হাতের কাছে গুছিয়ে রাখুন জল, দুধ, দই, ঘি, মধু, ফুল, বেলপাতা, গোলাপ জল, চন্দন বাটা, কুমকুম বা সিঁদুর, ধূপ, ঘিয়ের প্রদীপ, পাঁচটি ফল, মিষ্টি।

মহাশিবরাত্রিকে ভাগ করা হয় চারটি প্রহরে। এক একটি প্রহরে গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি করতে হয় একটি করে শিবলিঙ্গ। খেয়াল রাখুন, এক প্রহরের লিঙ্গের পূজা অন্য প্রহরে করা যায় না। কেন না, প্রহর ভেদে শিবের চারটি রূপের পূজা করা হয় এই রাতে। তবে, গঙ্গামাটি না পেলে বা শিবলিঙ্গ বানাতে না জানলে কালো পাথরের একটিই শিবলিঙ্গ বা বাণলিঙ্গ, নর্মদালিঙ্গ, রত্নলিঙ্গ ইত্যাদি বিহিত আধারে পূজা করা যায়। মহাশিবরাত্রির পূজার প্রথম ধাপ অভিষেক। অর্থাৎ, শিবলিঙ্গকে স্নান করানো।

প্রথম প্রহরে ‘ হৌঁ ঈশাণায় নমঃ’ মন্ত্রে দুধ দিয়ে, দ্বিতীয় প্রহরে ‘ হৌঁ অঘোরায় নমঃ’ মন্ত্রে দই দিয়ে, তৃতীয় প্রহরে ‘ হৌঁ বামদেবায় নমঃ’ মন্ত্রে ঘি দিয়ে এবং চতুর্থ প্রহরে ‘ হৌঁ সদ্যোজাতায় নমঃ’ মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পুজো করতে হয়। এই সময় প্রার্থনা করা হয়‚ হে শিব, তোমাকে নমস্কার। তুমি সৌভাগ্য, আরোগ্য, বিদ্যা, অর্থ, স্বর্গ, অপবর্গ দিয়ে থাকো। তাই এগুলো তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। হে গৌরীপতি, তুমি আমাদের ধর্ম, জ্ঞান, সৌভাগ্য, কাম, সন্তান, আয়ু ও অপবর্গ দাও।

অভিষেকের পরে শিবলিঙ্গে চারপ্রহরে চারটি অর্ঘ্য দেওয়া নিয়ম। চারপাশে জড়িয়ে দিতে হবে সাদা ও গোলাপী পদ্মের মালা। শিবলিঙ্গের মাথায় থাকবে বেলপাতা। ফুল এবং মালা দেওয়ার সময়ে উচ্চারণ করুন নমঃ শিবায়। তার পরে চন্দন বাটার প্রলেপ দিয়ে চন্দনের পরে কুমকুম বা সিঁদুরের আলেপন দিন। শিবের বন্দনায় ধূপ এবং ঘিয়ের প্রদীপ নিয়ে “নমঃ শিবায়ঃ” মন্ত্রে আরতি করুন। আরতি ও ভজন করার সময় যুক্তকরে মহাদেবের আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে হবে। কোমল হৃদয় মহাদেবের অনুকম্পা লাভ করতে মন্দিরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ঘণ্টা বাজাতে হবে। আরতির পর ফল এবং মিষ্টি নিবেদন করুন শিবকে। সবার শেষে সম্ভব হলে পাঠ করুন শিবের অষ্টোত্তর শতনাম। প্রত্যেক প্রহরেই এভাবে পুজো করুন শিবকে।

বেশিরভাগ পুজোতে পুজো সাঙ্গ হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়ার একটা পর্ব থাকে। শিবরাত্রি ব্রততে উপবাস চলে সারা দিন ও সারা রাত। পরের দিন সকালে প্রসাদ খেয়ে পূণ্যার্থীগন উপবাস ভঙ্গ করতে পারবেন। খেয়াল রাখবেন, মহাশিবরাত্রির পরের দিন সূর্যোদয়ের আগেই স্নান করে, চতুর্দশী তিথি থাকতে থাকতে উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। কোনও ব্রাহ্মণের কাছে শিবরাত্রির ব্রতকথা শুনে, তাঁকে দক্ষিণা দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করুন।

বিধি অনুযায়ী পূজা রাত্রির চার প্রহরে চার বার —দুধ, দই, ঘি ও মধু দিয়ে শিব স্নান কর্ত্তব্য।

প্রথমে সঙ্কল্প

ওঁ শিবরাত্রি ব্রতং হ্যেতৎ করিষ্যে দৃহং মহাফলং।

নির্বিঘ্নমস্তু মে দেব তৎপ্রাদাজ্জগৎপতে।।

এইবার বিধিসম্মত পূজা, নিচে বিবরন দেওয়া হলঃ

আসনে বসে রুদ্রাক্ষমালা, ভস্মত্রিপূণ্ড্র ধারণ করে পঞ্চবিধ শুদ্ধি, সূর্যার্ঘ্য, গুরু, ইষ্ট এবং পঞ্চদেবতার পূজা করতে হবে। বিশেষ স্নান ও অর্ঘ্য মন্ত্রে রাত্রির চার প্রহরে শিবপূজা কর্ত্তব্য।

প্রথম প্রহর

”ওঁ হৌঁ ঈশানায় নমঃ”—-মন্ত্রে দুধ দিয়ে স্নান করিয়ে পরে জলে স্নান করাতে হবে।

অর্ঘ্য মন্ত্র

ওঁ শিবরাত্রি ব্রতং দেব পূজাজপপরায়ণঃ।

করোমি বিধিবত্তং গৃহাণার্ঘ্যং মহেশ্বরঃ।।

দ্বিতীয় প্রহর

”ওঁ হৌঁ অঘোরায় নমঃ” —-মন্ত্রে দই দিয়ে স্নান করিয়ে পরে জলে স্নান করাতে হবে।

অর্ঘ্য মন্ত্র

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তাায় সর্ব্বপাপহরায় চ।

শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং প্রসীদ উময়া সহ।।

তৃতীয় প্রহর

”ওঁ হৌঁ বামদেবায় নমঃ” —-মন্ত্রে ঘি দিয়ে স্নান করিয়ে পরে জলে স্নান করাতে হবে।

অর্ঘ্য মন্ত্র

ওঁ দুঃখদারিদ্রশোকেন দগ্ধোঽহং পার্বতীশ্বর।

শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্তং প্রসীদ মে।।

চতুর্থ প্রহর

”ওঁ হৌঁ সদ্যোজাতায় নমঃ” —-মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পরে জলে স্নান করাতে হবে।

অর্ঘ্য মন্ত্র

ওঁ মমকৃত্যান্যনেকানি পাপানি হর শঙ্কর।

শিবরাত্রৌ দদামর্ঘ্যং উমাকান্তং গৃহাণ্ মে।।

প্রতিবার পূজার শেষে অষ্টমূর্তি, গৌরী, স্কন্দ, গণপতি, নন্দীশ্বরাদি শিবগণদের পূজা কর্তব্য। পূজার শেষে শিবনির্মাল্য দ্বারা চণ্ডেশ্বরের পূজা করনীয়। যে শিবরাত্রি পূজা বিধি দেওয়া হল, তা সাধারণ ভক্ত, যারা পুরোহিত দ্বারা বা প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে গিয়ে পূজা করবেন, তার কথা মাথায় রেখে বলা হয়েছে।

পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র :

সচন্দন পুষ্প ও বেলপাতা নিয়ে এই মন্ত্রে এক, তিন অথবা পাঁচ বার অঞ্জলি দেবেন—
ওঁ নমো শিবায় এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো শিবায় নমঃ।
(তিনবার পাঠ করবেন)

শিবের প্রণাম মন্ত্র:

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং গতিস্তং পরমেশ্বরম্।।

মহাশিবরাত্রি পূজার নির্ঘণ্ট

2022 শিবরাত্রি পূজার নির্ঘণ্ট

উৎসবের নামউৎসবের দিনউৎসবের তারিখ
মহা শিবরাত্রিমঙ্গলবার১ মার্চ ২০২২

পঞ্জিকা অনুসারে ৬ ই ফাল্গুন, মঙ্গলবার শ্রী শ্রী শিবরাত্রি ব্রত।সময় – রাত্রি ১২/৩৭/৩২ মধ্যে শিব রাত্রি ব্রত।

২০২১ শিবরাত্রি পূজার নির্ঘণ্ট

উৎসবের নামউৎসবের দিনউৎসবের তারিখ
মহা শিবরাত্রিবৃহস্পতিবার১১ মার্চ ২০২১

পঞ্জিকা অনুসারে – ২৬ শে ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার শ্রী শ্রী শিবরাত্রি ব্রত।

২০২০ শিবরাত্রি পূজার নির্ঘণ্ট

উৎসবের নামউৎসবের দিনউৎসবের তারিখ
মহা শিবরাত্রিশুক্রবার২১ ফেব্রুয়ারি

3 thoughts on “মহা শিবরাত্রির উপবাস পদ্ধতি পূজাবিধি”
  1. Right here is the perfect webpage for everyone who would like to understand this topic. You understand a whole lot its almost tough to argue with you (not that I really will need toÖHaHa). You certainly put a fresh spin on a subject that has been discussed for a long time. Wonderful stuff, just excellent!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright © All rights reserved.Rajbangshi.com